অচল মামলা সচল করা’র গল্প!
অচল মামলা সচল করা’র গল্প!
(মামলা করতে চান? সময় নিয়ে হলেও গল্পটা পড়বেন)
‘গাজী সেরাজদ্দিন। দাদার আমলে অনেক জায়গা-সম্পত্তি ছিল। বাবার আমলেই বিক্রি শুরু। নিজের আমলে তলানিতে তলিয়ে যায় সম্পত্তি। পাতিলের তলার ভাতে যে কারণে ‘কণা’ থাকে সে কারণে তলানির সম্পত্তিতেও সমস্যা থাকে। গাজী সেরাজদ্দিন মামলা করতে আসেন সদরে। এক আইনজীবী কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন ‘মামলা চলে না’। আইনজীবীর কথায় সেরাজদ্দিন খুশি হয়নি। কাগজপত্র ফেরত নিতে চাইলেই, আইনজীবী সাহেব,
- আমার পরামর্শ ফি?
- কাগজপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে আমার সময় নষ্ট হয়েছে, সেই সময়ের মূল্য?
- সময় নষ্ট তো আমারও হয়েছে।
বে-কায়দায় পড়ে গেলে কোনো উকিলই মক্কেলের সাথে কথায় কুলিয়ে উঠতে পারেন না। মক্কেল কাগজপত্র নিয়ে চলে গেল পাশের চেম্বারে। পাশের চেম্বারে লোকজন গিজগিজ করছে। বাবার সাথে মাঝে মাঝে সদরে আসার কারণে সেরাজদ্দিনকে অনেকেই চেনে। উকিল সাহেবের নজর পড়তেই,
- গাজী সাহেব কী কারণে সদরে?
- আর বলবেন না, এক মাঠে মড়া উকিলের কাছে এসেছিলাম মামলা করতে। আমার দিনটাই মাটি করে দিলো। সারা দিন কাগজ নাড়াচাড়া করে এখন কয়, মামলা চলে না।
- কে বলে মামলা চলে না। চালাতে জানলেই চলতে শুরু করবে। খরচপাতি একটু বেশি লাগে, এই আর কী!
বেশি খরচ দিতেই চলতে শুরু করে মামলা। অচল মামলা সচল রাখতে গিয়ে উকিল সাহেব কখনো চঞ্চল, কখনো অস্থির এবং কখনো গম্ভীর হয়ে উঠতেন। উকিল সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে এরকম বিপরীত আচরণ করতেন সেরাজদ্দিনও। উকিল সাহেবের অস্থির ভাব দেখে স্বস্তির ভাব নিয়ে মামলার হালচাল জানতে চাইত সেরাজদ্দিন। উত্তরে আইনজীবী,
- অচল মামলা তো, বড় কষ্ট করে সচল রাখতে হচ্ছে।
সেরাজদ্দিনও মানুষ, হাবভাব দেখেই উকিল সাহেবের কষ্ট বুঝতে পারেন। উকিলের কষ্ট বুঝতে পারেন বলেই অন্যান্য মক্কেল যেখানে ১০ টাকা খরচ করে, সেখানে সেরাজদ্দিন খরচ করেন ২০ টাকা। নিজের পেটের খরচ কমিয়ে উকিল সাহেবের খরচ বাড়িয়ে দেন। বছর পাঁচেক পর মামলা দো-তরফাসূত্রে খারিজ হয়ে যায়।
- এত ভালো মামলা খারিজ হয়ে গেল?
উকিল সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন সেরাজদ্দিন।
- হাকিম মামলা বোঝে না।
বিজ্ঞের মতো উত্তর দেয় বিজ্ঞ আইনজীবী।
- এখন কী করতে হবে?
বিষণ্ণ বদনে প্রশ্ন করেন সিরাজদ্দিন।
- আপিল করতে হবে।
বিজ্ঞের মতো উত্তর দেন আইনজীবী সাহেব।
আপিল দায়ের করতেই আবার চলতে শুরু করে মামলা। উভয় কোর্টের উকিল এক ব্যক্তি হলে কী হবে, নিম্ন আদালত আর আপিল আদালত এক নয়। আপিল আদালত বড় আদালত, খরচও বড়। সর্ব প্রকারের খরচ বাড়িয়ে দেয়া সত্ত্বেও উকিল সাহেবের খাটাখাটির কোনো মূল্যায়ন না করে বছর কয়েক পর বিজ্ঞ বিচারক নির্মমভাবে আপিলও খারিজ করে দেন।
-ওদের (হাকিমদের) মাথায় কিচ্ছু নেই। কী বই পড়ে হাকিম হয়েছে, বুঝতে পারলাম না। আমার ক্ষমতা থাকলে এসব মাথাবিহীন হাকিমদের বান্দরবান পাঠিয়ে দিতাম।
সেরাজদ্দিন কৈফিয়ৎ চাওয়ার আগেই সেরাজদ্দিনকে শুনিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে হাকিমের মাথা ও বিদ্যা-বুদ্ধির স্বল্পতা নিয়ে অনেক কথা বলেন বিজ্ঞ আইনজীবী সাহেব। আবার আপিল হয়। আবার খারিজ হয়, হয় রিভিশনও। রিভিশনও শেষ হয়। এক দিন শেষ হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালতও। মামলা চলাকালে মক্কেলের জ্বালা উকিল বুঝল- উকিলের জ্বালা মক্কেল বুঝল। দু’জনের মিলিত জ্বালা গত ২২ বছরেও বুঝল না বিচারক। মামলা সাথে সাথে জোয়ান সেরাজদ্দিন গাজীর টানটান চামড়াও ঢিলেঢালা হয়। ‘গাজী সেরাজদ্দিন’ নামটিও একসময় সংক্ষিপ্ত আকারে হয়ে পড়ে ‘ছিরোগাজী’।
শেষ বিচারের ভার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে এখন উকিলের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পালা। এক থলে কাগজপত্র নিয়ে গাজী সেরাজদ্দিন সে-ই আইনজীবীর চেম্বারের সামনে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল, যে-ই আইনজীবী বলেছিলেন, মামলাটি চলে না। সেদিন প্রথম আইনজীবীর পারিশ্রমিক না দিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে চলে গিয়েছিল সেরাজদ্দিন। প্রথম আইনজীবীর অবজারভেশন যে সঠিক ছিল, তা প্রমাণের জন্য মামলার ওপর পরোক্ষ নজর রাখতেন প্রথম আইনজীবীও। গাজী সেরাজদ্দিন ছিরোগাজী খেতাবসহ দ্বিতীয় আইনজীবীর চেম্বার থেকে বিদায় হয়ে যাওয়ার সময় খোঁচা দিয়ে,
- গাজী সাহেব, মামলার খবর কী?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই হন্ হন্ করে বের হয়ে যায় ছিরোগাজী। উত্তর দেন দ্বিতীয় আইনজীবী। কারণ, প্রথম আইনজীবীর কথার খোঁচা লেগেছিল দ্বিতীয় আইনজীবীর গায়েও। দ্বিতীয় আইনজীবী প্রথম আইনজীবীর কাছে এসে,
- আপনি তো বলেছিলেন ‘মামলাই চলে না’। আমি ২২ বছর চালাইলাম। জুনিয়ার থেকে সিনিয়র হলাম, ছেলে-মেয়ে মানুষ করলাম, বাড়ি করলাম, গাড়ি করলাম, (বৃদ্ধাঙ্গুলি মুখের কাছে নিয়ে) আপনি কী করছেন?
- (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, মনে মনে) ঠিকই তো, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেল, কিছুই তো করতে পারলাম না।
অচল মামলা সচল রাখতে কোনো কোনো আইনজীবীর ভাগ্যের চাকা খুলে গেলেও বন্ধ হয়ে পড়ে ক্লায়েন্টের জীবনের চাকা। ‘গাজী সেরাজদ্দিন’ সুন্দর নামটিও মামলাবাজ ‘ছিরোগাজী’তে রূপান্তর হয়ে এলাকায় হয়ে পড়েছিলেন উপহাসের পাত্র।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন